০৮:৫৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ জুন ২০২৫

আর্থোপ্রোডা পর্বের প্রাণী চ্যালা পোকা বা শতপদীর জীবনবৃত্তান্ত

সাইফুল ইসলাম জুয়েল
  • আপডেট: ১২:৩৯:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ১১ জুন ২০২৫
  • / 92

চ্যালা পোকা। সংগৃহীত ছবি 

সুন্দর ভদ্র কীটটির নাম ফায়ার সেন্ট্রিপিড—নাম শুনিলেই কেহ কেহ ভাবেন, ইহা বুঝি আগুন ছোঁড়ে, আর কেহ কেহ ভাবেন, ইহা বুঝি লম্বা হয়ে রেলগাড়ির মতো চলিতে থাকে, পিছনে ধোঁয়া ছাড়িয়া। বাস্তবে ইহা আগুনও ছোঁড়ে না, আর রেলও নহে; তবে হ্যাঁ, ভয় দেখাইতে জানে এবং শরীরে এমন সব আয়োজন রহিয়াছে, যাহা দেখিলে সাহসী লোকেরও অন্ততঃ এক পা পেছনে সরিয়া যাইতে হইতে পারে।

ইহার বৈজ্ঞানিক নাম Scolopendra subspinipes—এই নাম (স্কলোপেন্ড্রা সাবস্পিনাইপিস) উচ্চারণ করিবার পূর্বে এক গ্লাস পানি খাইয়া লওয়াই উত্তম। আর সাধারণ বিলাতী নাম “ফায়ার সেন্ট্রিপিড”— যাহার বাংলায় মানে আগুনের শতপদী! পা যদিও একশত মোটেই নহে, বড়জোড় ৪০ হইতে ৪৬টি হইয়া থাকে। তাহা হইলেও গুনিতে গুনিতে নয়নে বিভ্রান্তি চলিয়া আসে—সেইরূপই ঘন ও চলনসই পদক্ষেপ।

ইহার দৈর্ঘ্য গড়ে ১৫–২০ সেন্টিমিটার, তবে কেউ কেউ ২৫ সেন্টিমিটার অবধি বাড়িয়া যায়। এই পরিমাণে বাড়-বাড়ন্ত যদি চলতি পথে সাক্ষাৎ হইয়া যায়, তবে তাহাকে “আতিথ্য” না দিয়াই চটজলদি বিদায় করিতে হয়—সৌজন্য বজায় রাখিয়া, সাবধানে!

এই ভদ্রকীটরা থাকে গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে—দক্ষিণ চীন, ফিলিপাইন, হাওয়াই, ভারত, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে ইহার আধিপত্য। ইহার বাসস্থান একদম মাটির নিচে, পাথরের তলে, পুরাতন কাঠের ফাঁকে, ঘরে জমা করা পুরানা বইয়ের ভাঁজে, পাতার স্তূপে—যেখানে সূর্যের আলো ঢুকিবার সুযোগ নাই, সেইখানেই এই লালচে বিষবহুল ভদ্রকীট ফায়ার সেন্ট্রিপিড আশ্রয় লইয়া থাকেন।

দিনে অতিশয় শান্ত দেখাইলেও রাত্রি নামিলেই ইহার প্রকৃত রূপ প্রকাশিত হয়। নিশাচর, একাকী, এবং অতীব কর্মনিষ্ঠ। ক্ষুদ্র পোকা-মাকড় হইতে ব্যাঙ, এমনকি কখনও টিকটিকি, ছোট পাখির ছানাও ইহার ভোজনের তালিকায় পড়ে। এক অর্থে, এ এক ‘প্রাকৃতিক হোম ডেলিভারি অ্যাসাসিন’। শিকারে চলিবার সময় ইহা নিঃশব্দে আগায়। অতপর চট করিয়া কামড় দিয়া শিকারকে স্থবির করিয়া ফেলে—বিষ তাহার শরীরে ঢুকাইয়া জীবনের সকল আশা সাঙ্গ করিয়া দেয়।

ইহার বিষে আছে সেরোটোনিন, হিস্টামিন, অ্যাসিটাইলকোলিন—ইত্যাকার শ্রুতিমধুর নাম, কিন্তু প্রভাবে অমধুর। যাহারা কামড়ে পড়ে, শুধু তাহারাই জানেন ইহার ব্যথা ঘুমের মতো—আসে নিঃশব্দে, থাকে দীর্ঘক্ষণ। ব্যাপক ভয় পাওয়ার হেতু নাই, সাধারণত উহার বিষ প্রাণঘাতী নহে। একজন স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি কামড় খাইয়া ব্যথায় গড়াগড়ি খাইবেন বটে, কিন্তু ডাক্তারি সহায়তায় সারিয়া উঠিবেন।

প্রজননের ক্ষেত্রেও ফায়ার সেন্ট্রিপিড আত্মমর্যাদা রক্ষা করিয়া চলে। প্রেমপত্র বা চুম্বন নয়—পুরুষ একটি স্পার্ম প্যাকেট জমা রাখে, স্ত্রী তাহা নিজে সংগ্রহ করেন। তাহার পরে ডিম পাড়েন, ২০–৫০টি পর্যন্ত। এ বিষয়ে স্ত্রী সেন্ট্রিপিড অতিশয় যত্নবান, ডিমগুলিকে পাহারা দেন, শত্রুর মুখে ফুঁক দেন, এবং প্রয়োজনবোধে নিজেই কামড়াইয়া দেন।

তাহার সন্তানদের জন্ম হইবার পর তাহারা হয় নিম্ফ—তিন-চার জোড়া পা লইয়া শুরু করে, আর প্রতি বৎসর ধাপে ধাপে পরিণত হইয়া পূর্ণদেহ ধারণ করে। তাহার জীবনকাল প্রায় ৫–৭ বৎসর।

গণিত করিলে দেখা যায়—একটি পূর্ণবয়স্ক ফায়ার সেন্ট্রিপিড গড়ে দিনে ২–৩টি শিকার করে। বছরে তাহা হয় প্রায় ৭০০–১০০০টি কীট। যদি এক একর বনভূমিতে ২৫টি সেন্ট্রিপিড বাস করে, তবে তাহারা মিলিয়া বছরে ১৮,৭৫০টি কীট খাইয়া ফেলে।

এইরূপে ইহারা প্রকৃতির কীটনাশক—কোন রাসায়নিক নাই, কোন গন্ধ নাই, কেবল নিঃশব্দ সেবা। তবে খালি পায়ের নিচে যদি ইহা পড়ে, তখন সে আর পরিবেশসেবক থাকে না, পরিণত হয় এক চঞ্চল বিপদে।

তুলনায় দেখিলে, তাহাদের জ্ঞাতিভ্রাতা মিলিপিড অতিশয় শান্ত, উদ্ভিদভোজী, নিরীহ। টারান্টুলা ভয় দেখায়, কিন্তু কামড় খুব একটা দেয় না। আর সেন্ট্রিপিড? ইহা কামড়ও দেয়, ভয়ও দেখায়, এবং গলার রগ টানিয়া বলে—“আমি এখানে কর্মরত, বিরক্ত করিবেন না।”

এখন প্রশ্ন—মনুষ্য প্রজাতির কী করণীয়? উত্তর সরল:
১. ঘরদোর পরিষ্কার রাখিতে হইবে।
২. পাতার স্তূপ, কাঠ, বা ভেজা জায়গায় সাবধানে হাত দিতে হইবে।
৩. ফায়ার সেন্ট্রিপিড দেখিলে গুগল করিবার পরিবর্তে সরিয়া দাঁড়াইতে হইবে।

এই কীট ভয়ঙ্কর হইলেও প্রকৃতির পক্ষে অপরিহার্য। ইহা খায়, পরিষ্কার করে, শৃঙ্খলা বজায় রাখে। কেবল মানুষের শৌখিনতা অনুযায়ী সৌন্দর্য নাই, বলিয়া প্রকৃতিতে ইহার কার্যকারিতা অস্বীকার করা চলে না।

শেষে বলা যায়—ফায়ার সেন্ট্রিপিড আগুন নহে, তবে ছুঁইলে পোড়ায়। পোষা প্রাণী নয়, তবে উপকারী। সৌন্দর্য নয়, তবে সমীহযোগ্য। প্রকৃতির এই লালচে পায়ে চলা কর্মীটিকে ভয় না করিয়া শ্রদ্ধা করাই উত্তম বিবেকের পরিচায়ক।

আপনি ভয় পাইতেই পারেন, কিন্তু সে আপন গতি ও কর্তব্যে অটল। অতএব, সে যখন পাথরের নিচে অথবা আপনার পদযুগলের কাছে অর্ধচন্দ্রাকারে হাঁটিয়া চলে, তাহাকে বলেন—“চলো ভাই, তুমি তোমার পথে, আমি আমার!”

লিপি প্রায় সমাপ্ত, তবু কিঞ্চিত অপেক্ষা করুন।

প্রাণীকুল সম্বন্ধে বঙ্গসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের গাম্ভীর্যপূর্ণ রীতি অনুসরণ করিবার দুঃসাহসী প্রয়াসে আমি এক নগণ্য লিপিকার। ইহা লইয়া যদি কেহ কিঞ্চিত কৌতুক বা শ্লেষ করিয়া থাকেন, তাহাদের প্রতি আমার একান্ত প্রার্থনা—“ক্ষমা করিও ভাইগণ, ইহা কেবল প্রয়াস, প্রমত্ত প্রয়াস নহে।”

তবে হ্যাঁ, যদি কালেভদ্রে—জ্যোৎস্না রজনীর প্রশান্ত বাতাসে বা সাপ্তাহিক বিশ্রামের অলস বিকেলে—আপনার মনে হয়, “আহা! লেখকদ্বারা এমন এক চেলা-কানচেলার জীবনচরিত অতীব রসিক ও শিক্ষণীয় হইয়াছে,” তাহা হইলে বিনীত অনুরোধ—এই ক্ষুদ্র পৃষ্ঠাটিকে একবার লাইক দিয়া রাখিবেন।

আরেকটু বাড়তি আবদারও না হয় করিয়া ফেলি। যদি একখানা শেয়ার আপনার দয়ালু আঙুল হইতে বর্ষিত হয়, তবে আমি দুই হাতে হস্তজোড় করিয়া কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিব। কারণ আপনাদের ভালোবাসা পাইলেই আমি আরও বহু ‘ভদ্রকীট’ ও ‘ভদ্রপ্রাণী’র জীবনচরিত লইয়া হাজির হইতে পারিব—তখন আর কে বলিতে পারে, হয়তো “প্রাণীরাজ বঙ্কিমচন্দ্র” উপাধি নিজেই ধার করিয়া লইব!

পুনশ্চ: ইতোপূর্বে আমারই একখানা ফেসবুক লিপির মন্তব্যের গৃহে আপনারা ‘জল’ ও ‘পানি’ লইয়া যে বিতণ্ডা তুলিয়াছেন, তাহাতে বহু পানি বা জলঘোলা হইয়াছে। যাহা মোটেই কাম্য নহে। বঙ্গের ভাষা বাঙালির অহংকার, তাহাতে এই প্রকার লঘু তর্ক প্রীতিকর নহে। জল বলুন, পানি বলুন— হৃদয়ে যে তৃষ্ণা, তাহা দুইই মেটায়; ভাষা যে প্রেমে পালিত, তাহা কি এ হীন দ্বন্দ্বে কণ্টকিত হইবে?

আমার কোনো কথা অপ্রীতিকর মনে হইয়া থাকিলে, আমি আবারো করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করি। বঙ্গভাষার ভিন্নতা যেন বিভেদ না হয়, যেন তাহা হয় বৈচিত্র্যের আনন্দ-নৃত্য।

সাইফুল ইসলাম জুয়েল
প্রভাষক,জীববিজ্ঞান
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম পৌর মহিলা কলেজ,কিশোরগঞ্জ।

শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন

আর্থোপ্রোডা পর্বের প্রাণী চ্যালা পোকা বা শতপদীর জীবনবৃত্তান্ত

আপডেট: ১২:৩৯:১৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ১১ জুন ২০২৫

চ্যালা পোকা। সংগৃহীত ছবি 

সুন্দর ভদ্র কীটটির নাম ফায়ার সেন্ট্রিপিড—নাম শুনিলেই কেহ কেহ ভাবেন, ইহা বুঝি আগুন ছোঁড়ে, আর কেহ কেহ ভাবেন, ইহা বুঝি লম্বা হয়ে রেলগাড়ির মতো চলিতে থাকে, পিছনে ধোঁয়া ছাড়িয়া। বাস্তবে ইহা আগুনও ছোঁড়ে না, আর রেলও নহে; তবে হ্যাঁ, ভয় দেখাইতে জানে এবং শরীরে এমন সব আয়োজন রহিয়াছে, যাহা দেখিলে সাহসী লোকেরও অন্ততঃ এক পা পেছনে সরিয়া যাইতে হইতে পারে।

ইহার বৈজ্ঞানিক নাম Scolopendra subspinipes—এই নাম (স্কলোপেন্ড্রা সাবস্পিনাইপিস) উচ্চারণ করিবার পূর্বে এক গ্লাস পানি খাইয়া লওয়াই উত্তম। আর সাধারণ বিলাতী নাম “ফায়ার সেন্ট্রিপিড”— যাহার বাংলায় মানে আগুনের শতপদী! পা যদিও একশত মোটেই নহে, বড়জোড় ৪০ হইতে ৪৬টি হইয়া থাকে। তাহা হইলেও গুনিতে গুনিতে নয়নে বিভ্রান্তি চলিয়া আসে—সেইরূপই ঘন ও চলনসই পদক্ষেপ।

ইহার দৈর্ঘ্য গড়ে ১৫–২০ সেন্টিমিটার, তবে কেউ কেউ ২৫ সেন্টিমিটার অবধি বাড়িয়া যায়। এই পরিমাণে বাড়-বাড়ন্ত যদি চলতি পথে সাক্ষাৎ হইয়া যায়, তবে তাহাকে “আতিথ্য” না দিয়াই চটজলদি বিদায় করিতে হয়—সৌজন্য বজায় রাখিয়া, সাবধানে!

এই ভদ্রকীটরা থাকে গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে—দক্ষিণ চীন, ফিলিপাইন, হাওয়াই, ভারত, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে ইহার আধিপত্য। ইহার বাসস্থান একদম মাটির নিচে, পাথরের তলে, পুরাতন কাঠের ফাঁকে, ঘরে জমা করা পুরানা বইয়ের ভাঁজে, পাতার স্তূপে—যেখানে সূর্যের আলো ঢুকিবার সুযোগ নাই, সেইখানেই এই লালচে বিষবহুল ভদ্রকীট ফায়ার সেন্ট্রিপিড আশ্রয় লইয়া থাকেন।

দিনে অতিশয় শান্ত দেখাইলেও রাত্রি নামিলেই ইহার প্রকৃত রূপ প্রকাশিত হয়। নিশাচর, একাকী, এবং অতীব কর্মনিষ্ঠ। ক্ষুদ্র পোকা-মাকড় হইতে ব্যাঙ, এমনকি কখনও টিকটিকি, ছোট পাখির ছানাও ইহার ভোজনের তালিকায় পড়ে। এক অর্থে, এ এক ‘প্রাকৃতিক হোম ডেলিভারি অ্যাসাসিন’। শিকারে চলিবার সময় ইহা নিঃশব্দে আগায়। অতপর চট করিয়া কামড় দিয়া শিকারকে স্থবির করিয়া ফেলে—বিষ তাহার শরীরে ঢুকাইয়া জীবনের সকল আশা সাঙ্গ করিয়া দেয়।

ইহার বিষে আছে সেরোটোনিন, হিস্টামিন, অ্যাসিটাইলকোলিন—ইত্যাকার শ্রুতিমধুর নাম, কিন্তু প্রভাবে অমধুর। যাহারা কামড়ে পড়ে, শুধু তাহারাই জানেন ইহার ব্যথা ঘুমের মতো—আসে নিঃশব্দে, থাকে দীর্ঘক্ষণ। ব্যাপক ভয় পাওয়ার হেতু নাই, সাধারণত উহার বিষ প্রাণঘাতী নহে। একজন স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি কামড় খাইয়া ব্যথায় গড়াগড়ি খাইবেন বটে, কিন্তু ডাক্তারি সহায়তায় সারিয়া উঠিবেন।

প্রজননের ক্ষেত্রেও ফায়ার সেন্ট্রিপিড আত্মমর্যাদা রক্ষা করিয়া চলে। প্রেমপত্র বা চুম্বন নয়—পুরুষ একটি স্পার্ম প্যাকেট জমা রাখে, স্ত্রী তাহা নিজে সংগ্রহ করেন। তাহার পরে ডিম পাড়েন, ২০–৫০টি পর্যন্ত। এ বিষয়ে স্ত্রী সেন্ট্রিপিড অতিশয় যত্নবান, ডিমগুলিকে পাহারা দেন, শত্রুর মুখে ফুঁক দেন, এবং প্রয়োজনবোধে নিজেই কামড়াইয়া দেন।

তাহার সন্তানদের জন্ম হইবার পর তাহারা হয় নিম্ফ—তিন-চার জোড়া পা লইয়া শুরু করে, আর প্রতি বৎসর ধাপে ধাপে পরিণত হইয়া পূর্ণদেহ ধারণ করে। তাহার জীবনকাল প্রায় ৫–৭ বৎসর।

গণিত করিলে দেখা যায়—একটি পূর্ণবয়স্ক ফায়ার সেন্ট্রিপিড গড়ে দিনে ২–৩টি শিকার করে। বছরে তাহা হয় প্রায় ৭০০–১০০০টি কীট। যদি এক একর বনভূমিতে ২৫টি সেন্ট্রিপিড বাস করে, তবে তাহারা মিলিয়া বছরে ১৮,৭৫০টি কীট খাইয়া ফেলে।

এইরূপে ইহারা প্রকৃতির কীটনাশক—কোন রাসায়নিক নাই, কোন গন্ধ নাই, কেবল নিঃশব্দ সেবা। তবে খালি পায়ের নিচে যদি ইহা পড়ে, তখন সে আর পরিবেশসেবক থাকে না, পরিণত হয় এক চঞ্চল বিপদে।

তুলনায় দেখিলে, তাহাদের জ্ঞাতিভ্রাতা মিলিপিড অতিশয় শান্ত, উদ্ভিদভোজী, নিরীহ। টারান্টুলা ভয় দেখায়, কিন্তু কামড় খুব একটা দেয় না। আর সেন্ট্রিপিড? ইহা কামড়ও দেয়, ভয়ও দেখায়, এবং গলার রগ টানিয়া বলে—“আমি এখানে কর্মরত, বিরক্ত করিবেন না।”

এখন প্রশ্ন—মনুষ্য প্রজাতির কী করণীয়? উত্তর সরল:
১. ঘরদোর পরিষ্কার রাখিতে হইবে।
২. পাতার স্তূপ, কাঠ, বা ভেজা জায়গায় সাবধানে হাত দিতে হইবে।
৩. ফায়ার সেন্ট্রিপিড দেখিলে গুগল করিবার পরিবর্তে সরিয়া দাঁড়াইতে হইবে।

এই কীট ভয়ঙ্কর হইলেও প্রকৃতির পক্ষে অপরিহার্য। ইহা খায়, পরিষ্কার করে, শৃঙ্খলা বজায় রাখে। কেবল মানুষের শৌখিনতা অনুযায়ী সৌন্দর্য নাই, বলিয়া প্রকৃতিতে ইহার কার্যকারিতা অস্বীকার করা চলে না।

শেষে বলা যায়—ফায়ার সেন্ট্রিপিড আগুন নহে, তবে ছুঁইলে পোড়ায়। পোষা প্রাণী নয়, তবে উপকারী। সৌন্দর্য নয়, তবে সমীহযোগ্য। প্রকৃতির এই লালচে পায়ে চলা কর্মীটিকে ভয় না করিয়া শ্রদ্ধা করাই উত্তম বিবেকের পরিচায়ক।

আপনি ভয় পাইতেই পারেন, কিন্তু সে আপন গতি ও কর্তব্যে অটল। অতএব, সে যখন পাথরের নিচে অথবা আপনার পদযুগলের কাছে অর্ধচন্দ্রাকারে হাঁটিয়া চলে, তাহাকে বলেন—“চলো ভাই, তুমি তোমার পথে, আমি আমার!”

লিপি প্রায় সমাপ্ত, তবু কিঞ্চিত অপেক্ষা করুন।

প্রাণীকুল সম্বন্ধে বঙ্গসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের গাম্ভীর্যপূর্ণ রীতি অনুসরণ করিবার দুঃসাহসী প্রয়াসে আমি এক নগণ্য লিপিকার। ইহা লইয়া যদি কেহ কিঞ্চিত কৌতুক বা শ্লেষ করিয়া থাকেন, তাহাদের প্রতি আমার একান্ত প্রার্থনা—“ক্ষমা করিও ভাইগণ, ইহা কেবল প্রয়াস, প্রমত্ত প্রয়াস নহে।”

তবে হ্যাঁ, যদি কালেভদ্রে—জ্যোৎস্না রজনীর প্রশান্ত বাতাসে বা সাপ্তাহিক বিশ্রামের অলস বিকেলে—আপনার মনে হয়, “আহা! লেখকদ্বারা এমন এক চেলা-কানচেলার জীবনচরিত অতীব রসিক ও শিক্ষণীয় হইয়াছে,” তাহা হইলে বিনীত অনুরোধ—এই ক্ষুদ্র পৃষ্ঠাটিকে একবার লাইক দিয়া রাখিবেন।

আরেকটু বাড়তি আবদারও না হয় করিয়া ফেলি। যদি একখানা শেয়ার আপনার দয়ালু আঙুল হইতে বর্ষিত হয়, তবে আমি দুই হাতে হস্তজোড় করিয়া কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিব। কারণ আপনাদের ভালোবাসা পাইলেই আমি আরও বহু ‘ভদ্রকীট’ ও ‘ভদ্রপ্রাণী’র জীবনচরিত লইয়া হাজির হইতে পারিব—তখন আর কে বলিতে পারে, হয়তো “প্রাণীরাজ বঙ্কিমচন্দ্র” উপাধি নিজেই ধার করিয়া লইব!

পুনশ্চ: ইতোপূর্বে আমারই একখানা ফেসবুক লিপির মন্তব্যের গৃহে আপনারা ‘জল’ ও ‘পানি’ লইয়া যে বিতণ্ডা তুলিয়াছেন, তাহাতে বহু পানি বা জলঘোলা হইয়াছে। যাহা মোটেই কাম্য নহে। বঙ্গের ভাষা বাঙালির অহংকার, তাহাতে এই প্রকার লঘু তর্ক প্রীতিকর নহে। জল বলুন, পানি বলুন— হৃদয়ে যে তৃষ্ণা, তাহা দুইই মেটায়; ভাষা যে প্রেমে পালিত, তাহা কি এ হীন দ্বন্দ্বে কণ্টকিত হইবে?

আমার কোনো কথা অপ্রীতিকর মনে হইয়া থাকিলে, আমি আবারো করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করি। বঙ্গভাষার ভিন্নতা যেন বিভেদ না হয়, যেন তাহা হয় বৈচিত্র্যের আনন্দ-নৃত্য।

সাইফুল ইসলাম জুয়েল
প্রভাষক,জীববিজ্ঞান
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম পৌর মহিলা কলেজ,কিশোরগঞ্জ।

শেয়ার করুন