০২:৪১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫

চালু হচ্ছে প্রথম রোবোটিক পুনর্বাসন কেন্দ্র

ইউএনএ প্রতিবেদক
  • আপডেট: ১০:২১:১৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫
  • / 12

রিহ্যাব সেন্টারে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ জন রোগীকে উচ্চমানের পুনর্বাসন চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে -ছবি : ফাইল ফটো

রাত পোহালেই বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতে যুক্ত হতে যাচ্ছে এক নতুন যুগের সূচনা। আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএমইউ) স্থাপিত দেশের প্রথম রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার যা শুধু একটি হাসপাতালের ইউনিট নয় বরং প্রযুক্তি ও মানবসেবার এক যুগল প্রতিচ্ছবি। বিশেষ করে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে আহত, শহীদ ও জীবিত যোদ্ধাদের জন্য এটি যেন পুনরায় হাঁটতে শেখার নতুন আশা।

জানা গেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা-পুনর্বাসন নিশ্চিতই অন্যতম লক্ষ্য হবে এই রোবোটিক রিহ্যাব সেন্টারের। যেখানে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ জন রোগীকে উচ্চমানের পুনর্বাসন চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু জুলাই যোদ্ধাদের চিকিৎসা-পুনর্বাসনই নয় অন্যান্য সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে যাচ্ছে এই যুগান্তকারী উদ্যোগ।

বুধবার (২০ মে) সকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এই রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারের উদ্বোধন করবেন। এ সময় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম এবং চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনসহ আরও অনেকেই উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশের প্রথম রোবোটিক রিহ্যাব সেন্টারটিতে থাকছে ৬২টি উন্নত রোবোটিক থেরাপি ইউনিট। যার মধ্যে ২২টি চালিত হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে। দেশি ও বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দ্বারা পরিচালিত এই ইউনিট প্রতিদিন প্রায় ৩০০ জন রোগীকে উচ্চমানের পুনর্বাসন চিকিৎসা দিতে পারবে। শুধু প্রযুক্তির প্রয়োগ নয় এটি হবে একটি মূল্যবোধভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা, যেখানে প্রযুক্তি শ্রদ্ধা জানাবে সাহসী প্রাণদের আত্মত্যাগকে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করা জরিফুল ইসলাম জানান, মিছিলের সামনের সারিতে থাকায় আন্দোলনের সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। এরপর কোমর থেকে নিচে অবশ হয়ে যায় শরীর। বিছানা আর হুইলচেয়ারের সঙ্গে শুরু হয় নতুন জীবন। কিন্তু এখন তার চোখেমুখে নতুন আশার আলো। কারণ তাদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের লক্ষ্যে দেশের প্রথম রোবোটিক পুনর্বাসন সেন্টার চালু হওয়ার খবর ইতোমধ্যে জেনেছেন তিনি।

আহত আরেক তরুণ সাদিকুর রহমান, যিনি বুকে রবার বুলেটের আঘাতে মেরুদণ্ডে মারাত্মক জখম পেয়ে আহত হন। তিনি জানান, দুই মাস আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। শরীর নড়ছিল না। ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছিলাম। কিন্তু এখন যদি এই আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কিছুটা সুস্থ হয়ে আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি তাহলে বুঝব সেই দিনের লড়াই সার্থক হয়েছে।

সাদিক জানান, দেশে রোবটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার চালু হচ্ছে শোনার পর থেকে ভিডিওতে ইউরোপ-চীন-জাপানে রোবোটিক রিহ্যাবের ভিডিও দেখে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন।

এই জরিফুল-সাদিকদের মতো জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত আরও অনেকেই রোবোটিক রিহ্যাব সেন্টারের খবরে আশায় বুক বাঁধছেন। যন্ত্রনির্ভর এই আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি তাদের শুধু শরীর নয়, মনকেও নতুন করে বাঁচার সুযোগ দিচ্ছে। সুস্থতা এখন আর শুধু ওষুধ কিংবা হুইলচেয়ারে সীমাবদ্ধ নয় এটা হয়ে উঠছে প্রযুক্তিনির্ভর প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারটি মোট ৬২টি রোবোটিক ইউনিট দ্বারা সজ্জিত, যার মধ্যে ২২টি সরাসরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা চালিত। প্রতিটি যন্ত্র নির্দিষ্ট শারীরিক পুনর্বাসন চাহিদার ওপর ভিত্তি করে ডিজাইন করা হয়েছে। এর আওতায় থাকবে রোবোটিক গেইট ট্রেইনিং সিস্টেম, এক্সোস্কেলিটন থেরাপি, রোবোটিক আর্ম রিহ্যাবিলিটেশন ডিভাইস, এআই-বেইজড নিউরোফিডব্যাক সিস্টেম এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) থেরাপি সিস্টেমসহ আরও অসংখ্য রোবোটিক যন্ত্রপাতি।

রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে দায়িত্ব পাওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, এই রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে রোবোটিক আর্ম এক্সোস্কেলেটন। যা ব্যবহৃত হবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের হাঁটার ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে।

তিনি বলেন, সেন্টারটিতে থাকছে ইন্টেলিজেন্ট ব্যালান্স সিমুলেটর নামের একটি যন্ত্র যাদের মেরুদণ্ড বা ব্রেইন ইনজুরির ফলে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে সমস্যা হয় এটি তাদের সাহায্য করবে। এই যন্ত্রটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ভিত্তিক যেখানে রোগীরা ভার্চুয়াল ট্র্যাক অনুসরণ করে চলাফেরা শিখতে পারেন। এ ছাড়া ফিঙ্গার মোবিলাইজার ও পাম-গ্লাভ থেরাপি ইউনিট ব্যবহার করে হাতের প্যারালাইসিস বা গিলিয়েন-ব্যারে সিনড্রোমে আক্রান্তদের হাতের শক্তি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করা হয়।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলম বলেন, রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারটি বিশেষভাবে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময় আহত সাহসী ব্যক্তিদের বিনামূল্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য করা হয়েছে। এছাড়াও এই সেন্টারটি নানা ধরনের জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের চিকিৎসায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে যেসব রোগীর ফিজিক্যাল বা নিউরোলজিক্যাল ক্ষতি হয়েছে, তাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া হবে অনেক গতিশীল ও কার্যকর।

তিনি বলেন, এই সেন্টারে স্ট্রোকের কারণে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের জন্য থাকবে পূর্ণাঙ্গ রোবোটিক থেরাপি প্রোগ্রাম। যার মধ্যে রয়েছে মোটর স্কিল উন্নয়ন, ভারসাম্য বজায় রাখা এবং হাঁটা শেখানো। মেরুদণ্ডের ইনজুরির ফলে যারা প্যারালাইসিসের শিকার হয়েছেন, তারা পাবেন বিশেষভাবে কাস্টমাইজড রোবোটিক সাপোর্ট। দুর্ঘটনায় আহত পঙ্গু ব্যক্তি বা নার্ভ ইনজুরিতে যারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না তাদের জন্য থাকবে দীর্ঘমেয়াদি ফিজিক্যাল থেরাপির আয়োজন।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, চীনের সরকার কেবল উন্নত যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেই থেমে থাকেনি বরং আমাদের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একটি দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে। এর ফলে সেবার মান যেমন বেড়েছে তেমনি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় টেকনিক্যাল সক্ষমতাও দীর্ঘমেয়াদে বাড়বে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সেন্টারকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে দেশেই নিউরো-রিহ্যাবিলিটেশন প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও বিশেষায়িত চিকিৎসা কার্যক্রম গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এতে করে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য প্রযুক্তির দিক থেকে একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করবে, যা দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে।
চীন ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে জুলাইয়ের আহতরা রোবোটিক থেরাপির মাধ্যমে সুস্থ জীবনে ফেরার আশায় বুক বাঁধছেন / ঢাকা পোস্ট

আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষজ্ঞ টিমের সদস্য, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবির হিমু বলেন, এই রোবোটিক থেরাপি প্রযুক্তি দেশে রোগ নির্ণয় ও পুনর্বাসন চিকিৎসাকে আরও নির্ভরযোগ্য, আধুনিক এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করবে। বিশেষ করে যারা দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে যান কিংবা স্ট্রোকের পর চলাফেরার সক্ষমতা হারান, তাদের দ্রুত সুস্থ হয়ে কর্মজীবনে ফিরে আসার পথ তৈরি হবে।

তিনি আরও বলেন, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে শুধু শারীরিক নয়, মানসিক পুনর্বাসনও দ্রুততর হবে। পাশাপাশি যেসব রোগীকে এতদিন উন্নত থেরাপির জন্য বিদেশে পাঠাতে হতো সেই চাপ কমবে। এতে দেশের অর্থনৈতিক সাশ্রয় যেমন হবে তেমনি সাধারণ মানুষের চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগও বাড়বে।

উপাচার্য আরও জানান, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রম বেতার ভবনে সীমিত পরিসরে চালু রয়েছে। তবে একটি আন্তর্জাতিক মানের ডায়াগনস্টিক ল্যাব এবং রিসার্চ সেন্টার স্থাপনের লক্ষ্যে পূর্বাচলে ২০০ বিঘা জমির জন্য আবেদন প্রক্রিয়াধীন আছে। এটি অনুমোদন পেলে দেশের স্বাস্থ্যখাতে একটি স্থায়ী ও আধুনিক গবেষণাভিত্তিক অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন

চালু হচ্ছে প্রথম রোবোটিক পুনর্বাসন কেন্দ্র

আপডেট: ১০:২১:১৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫

রিহ্যাব সেন্টারে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ জন রোগীকে উচ্চমানের পুনর্বাসন চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে -ছবি : ফাইল ফটো

রাত পোহালেই বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতে যুক্ত হতে যাচ্ছে এক নতুন যুগের সূচনা। আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএমইউ) স্থাপিত দেশের প্রথম রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার যা শুধু একটি হাসপাতালের ইউনিট নয় বরং প্রযুক্তি ও মানবসেবার এক যুগল প্রতিচ্ছবি। বিশেষ করে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে আহত, শহীদ ও জীবিত যোদ্ধাদের জন্য এটি যেন পুনরায় হাঁটতে শেখার নতুন আশা।

জানা গেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা-পুনর্বাসন নিশ্চিতই অন্যতম লক্ষ্য হবে এই রোবোটিক রিহ্যাব সেন্টারের। যেখানে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ জন রোগীকে উচ্চমানের পুনর্বাসন চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু জুলাই যোদ্ধাদের চিকিৎসা-পুনর্বাসনই নয় অন্যান্য সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে যাচ্ছে এই যুগান্তকারী উদ্যোগ।

বুধবার (২০ মে) সকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এই রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারের উদ্বোধন করবেন। এ সময় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম এবং চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনসহ আরও অনেকেই উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশের প্রথম রোবোটিক রিহ্যাব সেন্টারটিতে থাকছে ৬২টি উন্নত রোবোটিক থেরাপি ইউনিট। যার মধ্যে ২২টি চালিত হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে। দেশি ও বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দ্বারা পরিচালিত এই ইউনিট প্রতিদিন প্রায় ৩০০ জন রোগীকে উচ্চমানের পুনর্বাসন চিকিৎসা দিতে পারবে। শুধু প্রযুক্তির প্রয়োগ নয় এটি হবে একটি মূল্যবোধভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা, যেখানে প্রযুক্তি শ্রদ্ধা জানাবে সাহসী প্রাণদের আত্মত্যাগকে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করা জরিফুল ইসলাম জানান, মিছিলের সামনের সারিতে থাকায় আন্দোলনের সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। এরপর কোমর থেকে নিচে অবশ হয়ে যায় শরীর। বিছানা আর হুইলচেয়ারের সঙ্গে শুরু হয় নতুন জীবন। কিন্তু এখন তার চোখেমুখে নতুন আশার আলো। কারণ তাদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের লক্ষ্যে দেশের প্রথম রোবোটিক পুনর্বাসন সেন্টার চালু হওয়ার খবর ইতোমধ্যে জেনেছেন তিনি।

আহত আরেক তরুণ সাদিকুর রহমান, যিনি বুকে রবার বুলেটের আঘাতে মেরুদণ্ডে মারাত্মক জখম পেয়ে আহত হন। তিনি জানান, দুই মাস আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। শরীর নড়ছিল না। ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছিলাম। কিন্তু এখন যদি এই আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কিছুটা সুস্থ হয়ে আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি তাহলে বুঝব সেই দিনের লড়াই সার্থক হয়েছে।

সাদিক জানান, দেশে রোবটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার চালু হচ্ছে শোনার পর থেকে ভিডিওতে ইউরোপ-চীন-জাপানে রোবোটিক রিহ্যাবের ভিডিও দেখে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন।

এই জরিফুল-সাদিকদের মতো জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত আরও অনেকেই রোবোটিক রিহ্যাব সেন্টারের খবরে আশায় বুক বাঁধছেন। যন্ত্রনির্ভর এই আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি তাদের শুধু শরীর নয়, মনকেও নতুন করে বাঁচার সুযোগ দিচ্ছে। সুস্থতা এখন আর শুধু ওষুধ কিংবা হুইলচেয়ারে সীমাবদ্ধ নয় এটা হয়ে উঠছে প্রযুক্তিনির্ভর প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারটি মোট ৬২টি রোবোটিক ইউনিট দ্বারা সজ্জিত, যার মধ্যে ২২টি সরাসরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা চালিত। প্রতিটি যন্ত্র নির্দিষ্ট শারীরিক পুনর্বাসন চাহিদার ওপর ভিত্তি করে ডিজাইন করা হয়েছে। এর আওতায় থাকবে রোবোটিক গেইট ট্রেইনিং সিস্টেম, এক্সোস্কেলিটন থেরাপি, রোবোটিক আর্ম রিহ্যাবিলিটেশন ডিভাইস, এআই-বেইজড নিউরোফিডব্যাক সিস্টেম এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) থেরাপি সিস্টেমসহ আরও অসংখ্য রোবোটিক যন্ত্রপাতি।

রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে দায়িত্ব পাওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, এই রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে রোবোটিক আর্ম এক্সোস্কেলেটন। যা ব্যবহৃত হবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের হাঁটার ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে।

তিনি বলেন, সেন্টারটিতে থাকছে ইন্টেলিজেন্ট ব্যালান্স সিমুলেটর নামের একটি যন্ত্র যাদের মেরুদণ্ড বা ব্রেইন ইনজুরির ফলে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে সমস্যা হয় এটি তাদের সাহায্য করবে। এই যন্ত্রটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ভিত্তিক যেখানে রোগীরা ভার্চুয়াল ট্র্যাক অনুসরণ করে চলাফেরা শিখতে পারেন। এ ছাড়া ফিঙ্গার মোবিলাইজার ও পাম-গ্লাভ থেরাপি ইউনিট ব্যবহার করে হাতের প্যারালাইসিস বা গিলিয়েন-ব্যারে সিনড্রোমে আক্রান্তদের হাতের শক্তি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করা হয়।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলম বলেন, রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারটি বিশেষভাবে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময় আহত সাহসী ব্যক্তিদের বিনামূল্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য করা হয়েছে। এছাড়াও এই সেন্টারটি নানা ধরনের জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের চিকিৎসায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে যেসব রোগীর ফিজিক্যাল বা নিউরোলজিক্যাল ক্ষতি হয়েছে, তাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া হবে অনেক গতিশীল ও কার্যকর।

তিনি বলেন, এই সেন্টারে স্ট্রোকের কারণে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের জন্য থাকবে পূর্ণাঙ্গ রোবোটিক থেরাপি প্রোগ্রাম। যার মধ্যে রয়েছে মোটর স্কিল উন্নয়ন, ভারসাম্য বজায় রাখা এবং হাঁটা শেখানো। মেরুদণ্ডের ইনজুরির ফলে যারা প্যারালাইসিসের শিকার হয়েছেন, তারা পাবেন বিশেষভাবে কাস্টমাইজড রোবোটিক সাপোর্ট। দুর্ঘটনায় আহত পঙ্গু ব্যক্তি বা নার্ভ ইনজুরিতে যারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না তাদের জন্য থাকবে দীর্ঘমেয়াদি ফিজিক্যাল থেরাপির আয়োজন।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, চীনের সরকার কেবল উন্নত যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেই থেমে থাকেনি বরং আমাদের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একটি দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে। এর ফলে সেবার মান যেমন বেড়েছে তেমনি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় টেকনিক্যাল সক্ষমতাও দীর্ঘমেয়াদে বাড়বে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সেন্টারকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে দেশেই নিউরো-রিহ্যাবিলিটেশন প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও বিশেষায়িত চিকিৎসা কার্যক্রম গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এতে করে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য প্রযুক্তির দিক থেকে একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করবে, যা দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে।
চীন ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে জুলাইয়ের আহতরা রোবোটিক থেরাপির মাধ্যমে সুস্থ জীবনে ফেরার আশায় বুক বাঁধছেন / ঢাকা পোস্ট

আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষজ্ঞ টিমের সদস্য, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবির হিমু বলেন, এই রোবোটিক থেরাপি প্রযুক্তি দেশে রোগ নির্ণয় ও পুনর্বাসন চিকিৎসাকে আরও নির্ভরযোগ্য, আধুনিক এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করবে। বিশেষ করে যারা দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে যান কিংবা স্ট্রোকের পর চলাফেরার সক্ষমতা হারান, তাদের দ্রুত সুস্থ হয়ে কর্মজীবনে ফিরে আসার পথ তৈরি হবে।

তিনি আরও বলেন, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে শুধু শারীরিক নয়, মানসিক পুনর্বাসনও দ্রুততর হবে। পাশাপাশি যেসব রোগীকে এতদিন উন্নত থেরাপির জন্য বিদেশে পাঠাতে হতো সেই চাপ কমবে। এতে দেশের অর্থনৈতিক সাশ্রয় যেমন হবে তেমনি সাধারণ মানুষের চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগও বাড়বে।

উপাচার্য আরও জানান, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রম বেতার ভবনে সীমিত পরিসরে চালু রয়েছে। তবে একটি আন্তর্জাতিক মানের ডায়াগনস্টিক ল্যাব এবং রিসার্চ সেন্টার স্থাপনের লক্ষ্যে পূর্বাচলে ২০০ বিঘা জমির জন্য আবেদন প্রক্রিয়াধীন আছে। এটি অনুমোদন পেলে দেশের স্বাস্থ্যখাতে একটি স্থায়ী ও আধুনিক গবেষণাভিত্তিক অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

শেয়ার করুন