‘প্রক্সি ভোট বাংলাদেশের জন্য খুব রিস্কি’

- আপডেট: ১০:১৫:০৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
- / 1
নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা -সংগৃহীত ছবি
প্রবাসীদের প্রক্সি ভোটে জালিয়াতির শঙ্কা রাজনৈতিক দলগুলোর। তারা বলেন প্রক্সি ভোট বাংলাদেশের জন্য খুব রিস্কি। উন্নত বিশ্ব যেখানে পারছে না, আমাদের নাগরিকরা যেখানে সত্যিকার নাগরিক হতে পারিনি সেখানে দলগুলো কিন্তু ফাঁকফোকর বের করে ফেলবে।
এদিকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার কার্যকরে প্রক্সি পদ্ধতির সম্ভাব্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। একই সঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও বলছে, এই পদ্ধতিতে জালিয়াতির আশঙ্কা থেকে যায়। আবার কোনো কোনো দল ঝুঁকিপূর্ণ বা ‘বিশ্বাসহীনতার কথা বলেছে এ পদ্ধতিকে।
প্রবাসীদের ভোটের ব্যবস্থা করতে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও দলগুলো বলছে, ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হলে প্রযুক্তি, নিরাপত্তা ও জনগণের আস্থার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে। অধিকাংশ দল এখনো দলীয় ফোরামে আলোচনা করে চূড়ান্ত মতো দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) নির্বাচন ভবনের অডিটোরিয়ামে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটের জন্য একটি নিরাপদ ও কার্যকর ভোটিং ব্যবস্থা তৈরির লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এমন অভিমত প্রকাশ করে রাজনৈতিক দলগুলো।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পরে প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার আগ্রহ বেশ দেখছি। ইসির কাছে আমাদের প্রত্যাশা যেন অর্ধেক না পরিপূর্ণ এফোর্ট দিয়ে যেন তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পারে। প্রক্সি ভোট হলে কোথাও কোথাও বেশি ভোট আসতে পারে৷ সেক্ষেত্রে এটা একটা থ্রেট হতে পারে। আমরা দলীয় ফোরামের আলোচনা করে ইসিকে মতামত জানাব।
এনসিপির ডায়াস্পোরা অ্যালায়েন্সের (জুলাই অভ্যুত্থানে অসামান্য অবদান রাখা প্রবাসী বাংলাদেশিদের রাষ্ট্র পুনর্গঠনমূলক কাজে সংগঠিত করার লক্ষ্যে গঠিত) সদস্য এহতেশামুল হক বলেন, ইসির ক্ষেত্রে বড় বাধা হচ্ছে গত ১৫ বছরে যে কলঙ্ক আছে সেটা থেকে উত্তরণ হওয়া৷ কেননা ইসি ভালো কাজ করলেও দুর্বলতা খুঁজে বের করার একটা প্রবণতা থাকবে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণবিধির ব্যাপারে ইসিকে একটা দৃঢ় অবস্থানে আসতে হবে। প্রবাসীরা আচরণবিধি প্র্যাকটিসে যদি আরেকটু সভ্য হতে পারি তাহলে ইসির জন্য আরেকটু কাজ করা সহজ হবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য জসিম উদ্দিন সরকার বলেন, উদ্যোগ নিলেই অর্ধেক কাজ হয়ে যায়। এটি ভালো উদ্যোগ। ট্রায়াল অ্যান্ড এররের (পর্যবেক্ষণ ও ত্রুটি) মধ্যে এগিয়ে যেতে হবে।
বিশ্বাসের ঘাটতি তৈরি হয়েছে গত ১৫ বছরে। ইসির প্রতি ট্রাস্ট অ্যান্ড কনফিডেন্স সবাই হারিয়ে ফেলেছে।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, আমরা ইসির সঙ্গে বৈঠকে প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়টি এনেছিলাম। ইসি সেই উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বিশ্বাসের ঘাটতি তৈরি হয়েছে গত ১৫ বছরে। ইসির প্রতি ট্রাস্ট অ্যান্ড কনফিডেন্স সবাই হারিয়ে ফেলেছে।
তিনি বলেন, দলীয় ফোরামে আলোচনার পরই পরবর্তীতে মতামত দেওয়া হবে। আমরা বিশ্বাস করি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হবে। কোনো অবস্থাতেই সিস্টেমকে ডেস্ট্রয় (ধ্বংস) করা যাবে না।
বিএনপি জানিয়েছে এ ব্যাপারে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে ইসিকে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। বৈঠক শেষে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রবাসীদের ভোটিংয়ের জন্য তিন প্রস্তাব (অনলাইন, প্রক্সি ও পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতির ভোটিং সিস্টেম) উপস্থাপন করা হয়েছে। আমরা আমাদের দলে আলোচনা করে মতামত দেব। কোনটা সবচেয়ে ভালো হয় সে মতামত দেব।
সহজ, বোধগম্য হবে ভোটিং পদ্ধতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই দুনিয়ায় কেনো সিস্টেমই ফুলপ্রুফ না। কোর্টশিপ করে বিয়েও ফুলপ্রুফ না। ফুলপ্রুফ হলে সংস্কার, বিপ্লবের প্রয়োজন হয় না। আমরা বিবেচনা করব সবচেয়ে যেটা সহজ, বোধগম্য হবে, সবচেয়ে যেটা গ্রহণযোগ্য হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে, যেটা সবচেয়ে সাশ্রয়ী হবে সেই প্রক্রিয়ার প্রতি আমরা সম্মত হতে পারব বলে আশা করি।
তিনি আরও বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের এই যে পারসেন্টেজের কথা বলা হচ্ছে এটার কোনো নির্ভরযোগ্যতা আছে কি না বলা যাবে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে কত মানুষ প্রবাসে স্থায়ী হতে যায় এই তালিকা কোথাও নেই। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বা বিএমইটি, কোথাও নেই। কত প্রবাসী ফিরে এসেছে সেই তালিকাও নেই। কাজেই এসব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হয়।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, দলীয় ফোরামে আলোচনা করে মতামত জানাব। প্রক্সির মাধ্যমে কী করে সিকিউরিটি নিশ্চিত করা যায়, সেটা ভেবে দেখতে হবে।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির শ্যাডো অ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারি আব্বাস ইসলাম খান বলেন, মিডিল ইস্ট’র প্রবাসীদের এনআইডি আছে। কিন্তু ওয়েস্টে (পশ্চিমা দেশে) কিন্তু বেশিরভাগেরই পাসপোর্ট আছে৷ তারা মিশনে গিযে কেন এনআইডি নেবে৷ কাজেই পাসপোর্টও যেন অপশন রাখা হয়।
তিনি আরও বলেন, এনআইডির ডাটা নিরাপত্তা দিতে পারিনি। তাই অনলাইন ভোটিংয়ে পাবলিক ট্রাস্ট নিয়ে আসতে হবে। কেননা শুরু করে সিকিউরিটি দিতে না পারলে বন্ধ হয়ে যাবে৷ অনলাইনে যেহেতু হ্যাক করা যায় সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকার আসলে কী হবে সে ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বাংলাদেশের কমিউন্সি পার্টির (সিপিবি) প্রেসিডিয়াম মেম্বার কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, অনলাইন, প্রক্সি ও পোস্টাল; তিনটি পদ্ধতিরই সুবিধা, অসুবিধা আছে। তবে দলগুলোর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
তিনি বলেন, প্রবাসে দেড় কোটি ভোটার, এর প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে আছে৷ তাই সতর্কতার সঙ্গে আরও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। তাই ইসির উচিত দলগুলোকে আস্থায় এনে যেন কাজ করে।
এদিকে সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রধান আবু লায়েন্স মুন্না বলেছেন, তার দল প্রক্সি ভোটিংয়ের পক্ষে নয়। বাংলাদেশ জাসদের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শাহজাহান আলী সাজু বলেন, তার দলও ফোরামে আলোচনা করে মতামত জানাবে। তবে তারা এয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মডেল নির্বাচন হিসেবে দেখতে চায়।
বাংলাদেশ মুসলীম লীগের অতিরিক্ত মহাসচিব আকবর হোসেন পাঠান বলেন, প্রবাসীদের ভোট নেন, তবে আগে দেশের ভেতরে ভোট সুষ্ঠু করেন।
দলটির সভাপতি কাজী আবুল খায়ের বলেন, প্রবাসীদের ভোটিং ব্যবস্থা নির্ধারণের পূর্বে দলগুলোর একমত হতে হবে যে ভুল হলেও মেনে নেব।
নাগরিক ঐক্যের সাংগঠনিক সম্পাদক সাকিব আনোয়ার বলেন, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে যেন ভুল না হয়। আস্থা ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি।
এছাড়া বাংলাদেশ লেবার পার্টির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, তার দল প্রক্সি ভোটের পক্ষে। অনলাইন ভোটিং নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, আর পোস্টাল ব্যালট নিয়ে আগ্রহ নেই। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস বলেছে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে মতামত দেবে। বাংলাদেশ কংগ্রেস পরে বিস্তারিত মতামত দেওয়ার কথা বললেও জালিয়াতির সুযোগ প্রক্সি ভোটের বিপক্ষে দলটি।
মতবিনিময় সভায় বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ ২১ দলের প্রতিনিধি উপস্থিত হন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির নজরুল ইসলামের খানের নেতৃত্বে ইসমাইল জবিউল্লাহ, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স অংশ নেন।
অনিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামির পক্ষে ছিল অ্যাডভোটেক জসিদ উদ্দিন, মতিউর রহমান আকন্দসহ তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল। এনসিপির যুগ্মআহ্বায়স খালেদ সাইফুল্লাহ এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, বাংলাদেশ লেবার পার্টির প্রতিনিধি।
এছাড়া নিবন্ধিত দলেল মধ্য এলডিপি, সিপিবি, জেএসডি, বাংলাদেশ মুসলীম লীগ, এনপিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিত, সাংস্কৃতি মুক্তিজোট, এনডিএম, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ জাসদ, এবি পার্টি, গণাধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি প্রতিনিধিসহ গণমাধ্যম, কারিগরি বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি অংশ নেন।
আলোচনায় প্রাধান্য পাওয়া বিষয়গুলো হলো প্রবাসী ভোটিং প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ; সিস্টেম ডিজাইন ও কারিগরি সম্ভাব্যতা; যথোপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন; প্রবাসী ভোটিং সিস্টেমের আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা এবং আইনি, লজিস্টিক ও কার্যকরী চ্যালেঞ্জগুলো এবং সম্ভাব্য সমাধান।
এএমএম নাসির উদ্দিন কমিশন প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোট পদ্ধতি নিয়ে গত ৮ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, এমআইএসটি, সমাজক্যাণ মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করে।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও এমআইএসটি নিয়ে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি তিনটি ভোটিং পদ্ধতির ওপর তিনটি প্রতিবেদন তৈরি করে। যে প্রতিবেদনগুলো উপস্থাপনার পরই সেমিনারে আলোচনায় অংশ নেন অংশীজনরা।
দুপুর পর্যন্ত আয়োজিত সেমিনারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন, চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব, বিভিন্ন দলের প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, গণমাধ্যমের প্রতিনিধিসহ প্রযুক্তিবিদরা উপস্থিত ছিলেন।