অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বাজেট নিয়ে যা চাওয়া
প্রবৃদ্ধির নতুন চলককে উদ্বুদ্ধ করতে হবে : হোসেন জিল্লুর রহমান

- আপডেট: ০২:২৩:৩৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫
- / 6
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান -ফাইল ছবি
বিভিন্ন রকম সরকার বিভিন্ন রকম বাজেট দেয়। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় বাজেট দিতে যাচ্ছে। পতিত রেজিমের রেখে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনীতির জের টানতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করছে অর্থনীতিতে নানা রকম সংস্কার আনার। কিন্তু সেই পদক্ষেপ আশানুরূপ নয়। ফলে অর্থনীতিতে নতুন সমস্যাও তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাজেট সামনে ইনটেরিমের কাছে কী আশা করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, দেশে বৈষম্য বহুমাত্রিক। অর্থনৈতিক ও সামাজিক পর্যায়ে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ একটি অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছে। শুধু রাজনৈতিক নয় অর্থনীতি থেকেও প্রতিযোগিতা হারিয়ে গেছে।
চারটি বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো হলো সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য, বিনিয়োগবান্ধব, সাম্প্রতিক আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসহ সবার কর্মসংস্থান ও মুদ্রাস্ফীতি কমানো। বর্তমান গভর্নর সেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, মেগা প্রজেক্টকে মেগা বলা ঠিক নয় এটাকে ভ্যানিটি প্রজেক্ট বলা উচিত। কারণ দেশের জন্য মেগা প্রজেক্ট অবশ্যই দরকার আছে। পলিসি দরকার। কিন্তু পলিসি হচ্ছে প্রথম স্তর ও বাস্তবায়ন হলো পরবর্তী পদক্ষেপ। এটা না হলে পলিসি কাগজে থেকে যায়।
তিনি আরো বলেন, দৃশ্যমান দুর্নীতি কমেছে তবে কাজের গতি কমে গেছে। লাল ফিতার সংস্কৃতি ভাঙতে হবে। হয়রানি দুর্নীতির চেয়ে ভয়াবহ। শুধু উপদেশ দিয়ে ঠিক করা যাবে না। সেটা কার্যকর করে দেখাতে হবে।
সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো :
* এবার বাজেট দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। ইনটেরিমের কাছে আপনি কী প্রত্যাশা করেন?
হোসেন জিল্লুর রহমান : আপনি বললেন যে বিভিন্ন সরকার বাজেট দেয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে একটা জিনিস দেখবেন, সব ধরনের সরকারের মধ্যে বাজেট রিলেটেড একটা ধারাবাহিকতা আছে। কারণ আমাদের এই বাজেট প্রক্রিয়াটা চূড়ান্তভাবে একটা আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং সেই আমলাতন্ত্র যেকোনো সরকারের মধ্যেই থাকে। এই আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রবণতা হচ্ছে মূলত যা চলছে তা-ই চলবে। মানে তেমন কিছু না, একটু এদিক-ওদিক।
কিছু জায়গায় সরকারে ভিন্নতার বিষয় দেখা যায়; যেমন: মেগাপ্রোজেক্টে আগের সরকারের এক ধরনের মোহ ছিল। কিন্তু সামগ্রিক অর্থে বাজেটে উন্নয়নের চেয়ে অনুন্নয়ন ব্যয় বাড়তে থাকে বেশি। এই অন্তর্বর্তী সরকারকে সম্পদস্বল্পতার কারণে দায়িত্বশীল অবস্থান থেকে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।
পাশাপাশি যে ব্যাপক জনআকাঙ্ক্ষা রয়েছে। সেদিকেও নজর দিতে হবে। সুতরাং একই সঙ্গে বাজেটে সম্পদস্বল্পতা ও জনআকাঙ্ক্ষার সমন্বয় করতে হবে। বাজেটে তিনটা বিষয় দেখতে হবে, ন্যারেটিভ মানে বিশ্লেষণ মানে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি এবং সমস্যার একটা ব্যাখ্যা, দ্বিতীয়টা বরাদ্দ আর তৃতীয়টা সিগন্যাল। আমরা তিনটা মিলে বুঝতে পারব যে সরকার কোন কোন সমস্যা অ্যাড্রেস করছে।
–
* আমরা জানতে পেরেছি বাজেটে আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট বাড়বে। এক্ষেত্রে আইএমএফের শর্তের প্রভাব কতখানি পড়বে বলে আপনি মনে করেন?
হোসেন জিল্লুর রহমান : আইএমএফের প্রভাব কিন্তু এরই মধ্যে পড়েছে। ডলারের বিনিময়মূল্য কিভাবে নির্ধারিত হবে সেটাতে আইএমএফের পরামর্শ মেনে নেওয়া হয়েছে। শুল্ক-করের ব্যাপারে আমার মনে হয় না আইএমএফের সুনির্দিষ্ট পরামর্শ আছে। কিন্তু আমাদের রাজস্ব আহরণের চেষ্টাটা বাড়ানোর একটা বিষয় রয়েছে।
কিন্তু জুলাই-আগস্টে পটপরিবর্তনের দাবির মূল বিষয়টা কী ছিল? বৈষম্য, ইনসাফ এ শব্দগুলোই তো আমাদের নাড়া দিয়েছে। এখানেও তো সেগুলো চলে আসে। এই যেমন : কর। কর বাড়বে, বাড়তে পারে। আমাদের তো রাজস্ব আহরণ করতে হয়। উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন করতে হয়। তাহলে এসব তো বাড়াতে হবে। কিন্তু আমরা অপ্রত্যক্ষ করের ওপরই নির্ভরশীল বেশি।
প্রত্যক্ষ কর, যেটা আয়কর, সেটা তুলনামূলক কম। ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স, যেটাকে ভ্যাট বলি, সেটার প্রভাব সরাসরি ভোক্তার ওপর পড়বে। মানে সবার ওপর। এখানে ইনসাফের অ্যাঙ্গলটা কিভাবে বের করা যায়! দরিদ্র ভোক্তারা যেসব বিষয় বেশি ভোগ করেন সেগুলোতে সহনীয়ভাবে ট্যাক্স বা ভ্যাট বাড়ছে কি না, সেগুলো দেখার বিষয় আছে। আয়কর তো বাড়ে আর মানুষ আসলে প্রয়োজন হলে দিতে প্রস্তুত থাকে। এখানে কর প্রশাসনকে সংস্কার করার একটা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেটার কার্যকারিতা দেখার বিষয় আছে। মূল্যায়ন করার বিষয় এখনো আসেনি।
আইএমএফের যেটা আপনি বললেন, সেখানে কর প্রশাসন সংস্কারের কথা আসছে। আমরা অবশ্য ডিটেইলস দেখিনি। খাতওয়ারি বিন্যাসে আইএমএফের পরামর্শের কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কি না, সেটা দেখা দরকার। সামাজিক খাতের আনুপাতিক হারটার ওপর কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কি না, দেখার বিষয় আছে।
কারণ আমরা জানি যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য দুটিতেই তুলনামূলকভাবে বাজেট কমে গেছে। একটা বিষয় থাকতে পারে যে আয়-ব্যয়ের সমঞ্জস করা। এটা সাধারণ অর্থে আইএমএফের চাওয়া হতে পারে। এটা আমাদেরও চাওয়া। কিন্তু এই সামঞ্জস্যটা, ভারসাম্যটা আনার পথ নানা রকম হতে পারে। এখানেই আমাদের বৈষম্য কমানো, ইনসাফ নিশ্চিত করা, আবার একই সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক খাতগুলো যেসব প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোকে এক ধরনের উৎসাহ দেওয়া দরকার।
* আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক আমাদের জিডিপি কম আসবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এবং সরকারের মূল্যায়নও কাছাকাছি। মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। আবার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষা পূরণের বিষয় আছে। সমন্বয়টা কিভাবে হবে বলে আপনি মনে করেন?
হোসেন জিল্লুর রহমান : জনআকাঙ্ক্ষা এমন নয় যে অবাস্তব কিছু করো। মূল্যস্ফীতি কিন্তু অবাস্তব না। মূল্যস্ফীতি কমানো তো একটা যৌক্তিক চাওয়া এবং সেটা কিভাবে কমাতে পারি সেদিকে সুস্পষ্ট নীতিমালা করা। এটা তো অবাস্তব চাওয়া নয়। জনআকাঙ্ক্ষা মানেই যে অবাস্তব কিছু চাওয়া হচ্ছে তা নয়। সেজন্য বলছি যে সম্পদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে বোঝাপড়াটা কিভাবে করব, এই জায়গায় পরিষ্কার নজর দেওয়া দরকার। এখানে যেমন আমি বলতে পারি, আমাদের অনুন্নয়ন ব্যয়, যাকে পরিচালন ব্যয় বলে এখানে আসলে কৃচ্ছ্রসাধন কিভাবে করা যায় সেটা দেখতে হবে।
* সরকারি পেশাজীবীদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হচ্ছে। পরিচালন ব্যয় তো সরকার কমাতে পারছে না…
হোসেন জিল্লুর রহমান : অনুন্নয়ন ব্যয়টা যদি এক ধরনের কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যে আনা না হয় তাহলে সেটা ইনসাফ-বৈষম্যের সঙ্গে মিলছে না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, উদ্যোক্তা শ্রেণিকে সেই অর্থে উৎসাহিত করতে হবে। বাজেটের মধ্যে তিনটি জিনিস থাকা উচিত। আমরা বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু বাজেটের মধ্যে অর্থনীতির সার্বিক গতিময়তার জন্য তিনটি ডাইমেনশন আছে বরাদ্দের জন্য।
একটি হচ্ছে বরাদ্দ। কিন্তু আরো দুটি বড় বিষয় আছে। তার একটি হচ্ছে সমস্যার চিত্রায়ণ। এই যে বরাদ্দগুলো করছি, এগুলো কোনো বিশ্লেষণের ভিত্তিতে করছি, নাকি চোখ বন্ধ করে করছি। যেটাকে আমরা বলি বাজেট ন্যারেটিভ। এই সরকারে বাজেট ন্যারেটিভের জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।
পতিত সরকারের সময় বাজেট ন্যারেটিভটাই একটা সমস্যা ছিল। ওই ন্যারেটিভের সবকিছুই মনে হতো অসম্ভব সুন্দর। সবই চলছে, সমস্যার কিছু নাই। ন্যারেটিভের সঙ্গে বরাদ্দের হয়তো কোনো সম্পর্কই নাই।
কিন্তু সমস্যার বিষয়টা বুঝছি কি না, আমার তো সীমিত সম্পদের মধ্যে সব করা দরকার সে ক্ষেত্রে চয়েসগুলো কী সেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা। এটা গুরুত্বপূর্ণ। আরেকটা হচ্ছে সিগন্যালিং। সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে আমি কিন্তু বিভিন্ন শ্রেণিকে সিগন্যাল দিচ্ছি। দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য ভাতা প্রোগ্রামগুলোর অবস্থা কী? সেখানে ওএমএসের পরিমাণটা একটু বাড়ানো হচ্ছে কি না। এগুলো কিন্তু এক ধরনের সিগন্যাল। আবার গ্রামীণ কর্মসংস্থানের দিকে নজর দেওয়া হয়েছে কি না, সেটাও একটা বার্তা বহন করে। কৃষিকে এক ধরনের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে আনা হলে সেটা এক ধরনের সিগন্যাল আর না হলে সিগন্যালটা অন্য রকম। শিক্ষা, স্বাস্থ্যের বরাদ্দ কমে গেল, সেটার মধ্যে আমরা কোন সিগন্যাল দেখছি? আবার বরাদ্দ কমলেও সেখানে প্রকল্প বিন্যাসটা কী রকম অবকাঠামো, নাকি গবেষণা, শিক্ষা উন্নয়ন, বেতন-ভাতা ইত্যাদি। সম্পদ নেই, কী করব? তাই কমিয়ে দিলাম। কিন্তু তার মধ্যেও ব্যতিক্রমী ছোটখাটো পদক্ষেপ দিয়েও ভিন্ন সিগন্যাল দেওয়া যায় যে আমরা চেষ্টা করছি।
* আমরা তো রেমিট্যান্স ও গার্মেন্টসে আটকে আছি। অন্য খাত এক্সপ্লোর করার কোনো ন্যারেটিভ তো দেখি না। তহেলে আয় বাড়বে কিভাবে!
হোসেন জিল্লুর রহমান : বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির গন্তব্যটাকে আমরা ভিন্নভাবে সাজিয়েছি। এত দিন আমরা গার্মেন্টস ও রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। সেগুলো চলবেই। কিন্তু প্রবৃদ্ধির নতুন চলককে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। যেমন : কৃষি একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রবৃদ্ধির চলক হতে পারে, ফার্মাসিউটিক্যালস হতে পারে, আইটি সার্ভিসেস হতে পারে, লেদার ইত্যাদি হতে পারে। এজন্য প্রবৃদ্ধির নতুন চলকগুলোর প্রতি মনোযোগ দেখাতে হবে।
প্রাথমিকভাবে এখানে বরাদ্দটা বড় বিষয় নয় এখানে বড় বিষয় হচ্ছে, নীতি মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ওগুলো আসছে কি না। ওইখানে নতুন করে নীতিমালা সাজানো হচ্ছে কি না এবং প্রাথমিকভাবে কিছু উৎসাহের জন্য বরাদ্দ হচ্ছে কি না। এগুলো হচ্ছে বিষয়। আলোচনাটা হয় শুধু আজকের সীমাবদ্ধ সম্পদের পরিপ্রেক্ষিতে কিন্তু নীতিমালা ভিন্নভাবে সাজালে তার বাইরেও আমরা আলাপ চালাতে পারব।
*তথ্যসূত্র : দৈনিক কালের কণ্ঠ ও দৈনিক ইনকিলাব