বিগত সময়ের কাঠামোর অনুকরণেই বাজেট প্রণীত

- আপডেট: ০৯:৪১:১৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ জুন ২০২৫
- / 8
সংগৃহীত ছবি
‘বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়’ শীর্ষক আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, প্রথাগত ভৌত অবকাঠামো তৈরির খতিয়ানের পরিবর্তে বাজেটে মানুষকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, বিগত সময়ের কাঠামোর অনুকরণেই বাজেট প্রণীত হয়েছে। শুধু বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দের কিছু তারতম্য হয়েছে মাত্র। এ ছাড়া ঋণের সুদ পরিশোধে প্রাধান্য দিয়ে দেনার গ্লানি ঘোচানোর বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে বাজেটে। সার্বিক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এ বছরের বাজেট যেন আয়-ব্যয়ের ধারাপাত।
যদিও দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতি সামলাতে মাত্র কয়েক মাস সময় পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দু-একটি খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছে। গন্তব্য তাই এখনো অনেক দূর। কঠিন কাজটি করতে সামনে আছে নানা চ্যালেঞ্জ।
সেই বাস্তবতা মেনে নিয়ে আর মনে করিয়ে দিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাজেট দিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। গত সোমবার (২ জুন) তিনি ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, ‘বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে আমরা এগোচ্ছি।’
এই একটি মন্তব্যেই যেন উঠে আসে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় চিত্র কীভাবে এক গভীর সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই চলছে, আর কেন এই যাত্রাপথ এখনো দীর্ঘ।
তবে এই কঠিন বাস্তবতা মোকাবিলায় অর্থ উপদেষ্টা বাজেট যেভাবে সাজালেন, তার খুব প্রশংসা করতে পারছেন না অর্থনীতিবিদ, বিশ্লেষক এবং রাজনৈতিক দলগুলো। তারা বলছে, এই বাজেট যেন আগের সরকারেরই ধারাবাহিকতা। এতে সেই অর্থে পরিবর্তন আছে খুবই সামান্য। শুধু এই খাতে কিছু কম, ওই খাতে কিছু বেশি।
তবে বাজেট বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, সংকটের দিকগুলোতে সরকারের চোখ খোলা আছে। তিনি জানান, সরকার কাজ করছে তিনটি ‘শূন্য’ লক্ষ্য নিয়ে শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বন। লক্ষ্য এমন একটি সমাজ গড়া, যেখানে সবাই সুন্দর জীবন পাবে এবং বৈষম্য থেকে মুক্ত থাকবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
তবে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাজেটের রাজস্ব পদক্ষেপকে ‘সাহসী’ বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, এবার আয়কর অব্যাহতির ক্ষেত্রে যাদের সাধারণত ধরা যায় না। তাদেরও করের আওতায় আনার চেষ্টা করা হয়েছে। ভ্যাট অব্যাহতিও ব্যাপকভাবে কমানো হয়েছে।
অন্যদিকে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমদানি প্রতিযোগিতা মোকাবিলায় যেভাবে উদ্যোক্তারা আগে শুল্ক-ভ্যাটের মাধ্যমে সুরক্ষা পেতেন, তা-ও কমানো হয়েছে। ফলে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে সরকার কিছু কঠিন কিন্তু স্পষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, দেশের উদ্যোক্তারা এসব পরিবর্তনে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখান।
সবকিছু মিলিয়ে এখনো পক্ষাঘাতগ্রস্তই বলা যায় দেশের অর্থনীতিকে। সরকারের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার জায়গা এখনো মূল্যস্ফীতি; যা কিছুটা কমলেও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক চাপ আর বাজারভিত্তিক ডলার বিনিময় হারের প্রভাব নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন অনিশ্চয়তা।
রেমিট্যান্স ছাড়া প্রায় সব অর্থনৈতিক সূচকই দুর্বল। কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না, বিনিয়োগে নেই আস্থা। আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতিও অনুকূল নয়। সাধারণ মানুষের আয় বাড়ছে না, অথচ ব্যয় লাগামহীন। দেশের ৮০ শতাংশ সম্পদ মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের হাতে। ফলে প্রবৃদ্ধির সুফলও পৌঁছায় না সবার কাছে। আর এখন তো সেই প্রবৃদ্ধিও নিম্নমুখী।
চলমান বাস্তবতার প্রতিফলনেই এবারের বাজেট কিছুটা ভিন্ন ধাঁচের। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রস্তাবিত বাজেট আগের বছরের তুলনায় ছোট; এবং প্রবৃদ্ধি নয়, এবার জোর দেওয়া হয়েছে মানুষের সামগ্রিক কল্যাণে। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব জীবিকার নিরাপত্তা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, সুশাসন, কর্মসংস্থান ও নাগরিক সুবিধা এই বাজেটের কেন্দ্রে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, জলবায়ু পরিবর্তন এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ-সুযোগ সামাল দেওয়ার প্রস্তুতির কথাও এসেছে বাজেটে। পাশাপাশি জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ভেঙে পড়া নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কারকেই দেওয়া হয়েছে অগ্রাধিকার।
তাই এবারের বাজেট শুধু আয়-ব্যয়ের হিসাব নয় বরং এটি সরকারের জন্য একধরনের কৌশলগত রূপরেখা। মূল লক্ষ্য সংযমী ব্যয়, কাঠামোগত সংস্কার এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। সরকার চাইছে সাম্প্রতিক চাপ মোকাবিলা করে, আইএমএফের প্রতিশ্রুতি পালন করে এবং দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার চালিয়ে একটি টেকসই ও স্থিতিশীল ভবিষ্যতের ভিত্তি তৈরি করতে।
এটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম এবং দেশের ৫৫তম বাজেট। ৮৮ পৃষ্ঠার বক্তব্যে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার ব্যয় পরিকল্পনার মাধ্যমে সংকটময় অর্থনীতি থেকে উত্তরণ এবং জনজীবনে স্বস্তি ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে তিনি ব্যবসা এবং সাধারণ মানুষের ওপর বাড়তি চাপের ইঙ্গিতও দিয়েছেন। মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য থাকলেও তার বাস্তবায়ন কৌশল ছিল খুবই সাধারণ ও পুরোনো ধারার। আয় বাড়াতে গ্রামীণ কর্মসংস্থানের কথা বলা হলেও সার্বিক কর্মসংস্থান বা বিনিয়োগে গতি আনতে বড় কোনো কর্মসূচি দেওয়া হয়নি। করমুক্ত আয়সীমাও অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে ভবিষ্যৎ সরকারের বিবেচনায় ছেড়ে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মাদ আবদুল মজিদ বলেন, বিশেষ সময়ে বিশেষ সরকার বিশেষ বাজেট দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের নিজস্ব কোনো অ্যাজেন্ডা নেই। এ জন্য তারা অসুস্থ অর্থনীতিকে সুস্থ ধারায় ফেরাতে বাজেট দিয়েছে।
কালোটাকা ও অপ্রদর্শিত অর্থের বিষয়ে হঠাৎ কড়া অবস্থানের আভাস মিললেও বাজেটে আগের মতোই আবাসনসহ কয়েকটি খাতে এসব অর্থ ব্যবহারের সুযোগ বহাল রাখা হয়েছে। স্বচ্ছতা নিশ্চিতে জমি-ফ্ল্যাটের নিবন্ধন বাজারমূল্য অনুযায়ী নির্ধারণের প্রস্তাব দেওয়া হলেও এতে করহার কমানোর কথা বলা হয়েছে, যা খাতটিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং কালোটাকার প্রবাহ বাড়াবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে বাজেটে ঘাটতি ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা বা জিডিপির ৩.৬ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, যার বড় অংশ ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা—তোলা হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকেই নেওয়া হবে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা। এতে বিনিয়োগ সংকোচন ও সুদহার বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণনির্ভরতা অব্যাহত থাকায় বছরে সুদ-আসলে সরকারের ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা।
বাজেট ছোট করা হলেও সরকারের পরিচালন ব্যয় আগের তুলনায় বেড়েছে। পরিচালন ব্যয়ের ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সামাজিক সুরক্ষা ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা, সুদ পরিশোধ খাতে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি, ভর্তুকি ৮৯ হাজার ১৬২ কোটি, বেতন-ভাতায় ৯৭ হাজার কোটি এবং অন্যান্য খাতে ১ লাখ ৩৫ হাজার ১০৭ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা।
বাজেটে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও তরুণ উদ্যোক্তা তৈরিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সফল যুব উদ্যোক্তাদের ঋণসীমা বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, পাশাপাশি তরুণদের জন্য প্রথমবারের মতো ১০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠনের প্রস্তাব এসেছে। একই উদ্দেশ্যে ‘তারুণ্যের উৎসব’ আয়োজনে আরও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ও শহীদ পরিবারের জন্য আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্পসহ ৪০৫ কোটি টাকার আলাদা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিজ্ঞানভিত্তিক ও কর্মমুখী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষায় ৩৫ হাজার ৪০৩ কোটি, মাধ্যমিক-উচ্চশিক্ষায় ৪৭ হাজার ৫৬৩ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসাশিক্ষায় ১২ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে ৪১ হাজার ৯০৮ কোটি এবং কৃষি ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর জন্য বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। দরিদ্রদের স্বাস্থ্যসেবা, টিকাদান ও সামাজিক সুরক্ষা জোরদারেও বরাদ্দ বেড়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় ভাতার পরিমাণ এবং উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ বিভিন্ন ভাতা মাসিক ৫০-১০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে মাথাপিছু সহায়তা বাড়ানো হয়েছে। স্মার্ট ফ্যামিলি কার্ডের আওতায় ৫৭ লাখ পরিবারকে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মেয়াদ ছয় মাসে উন্নীত করারও প্রস্তাব রয়েছে।
বিদেশি বিনিয়োগে গতি আনতে বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি থেকে প্রকৃত বিনিয়োগে রূপান্তরের জন্য একটি ট্র্যাকিং সিস্টেম চালুর কথা বলা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) প্রকল্প বাস্তবায়নে ৫ হাজার ৪০ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া শুল্ককাঠামোয় পরিবর্তন এনে স্থানীয় শিল্প সুরক্ষা ও আমদানিনির্ভর পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ থাকলেও এতে কিছু গোষ্ঠীর সুবিধা এবং বাজারে মূল্য অস্থিরতার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সিপিডির মতে, বাজেটটি অন্তর্বর্তী এবং সংযত ধারায় প্রণয়ন করা হলেও বাস্তবায়ন নির্ভর করবে অর্থনীতির গতি ও প্রবৃদ্ধির বাস্তবতায়।
ঘাটতি অর্থায়নেও সরকার হাঁটছে গতানুগতিক পথে। অভ্যন্তরীণ ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়া লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক থেকে ঋণের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। এভাবে সরকার যদি ব্যাংক খাতের ওপর বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাহলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ হ্রাস পাবে, যা প্রকারান্তরে কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, জুলাই আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল মূলত বেকারত্ব সমস্যা সমাধানের দাবিতে। দেশের বেসরকারি খাত শ্রমবাজারে প্রবেশ করা জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারায় সবাই সরকারি চাকরির মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কোটা ব্যবস্থার কারণে সরকারি চাকরিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রবেশের সুযোগ সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। এ বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যেই আন্দোলনে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু আগামী অর্থবছরের কত মানুষের কর্মসংস্থান হবে, সে বিষয়ে কোনো পক্ষেপণ বাজেটে নেই। সরকারি, বেসরকারি ও বৈদেশিক খাতে আগামী এক বছরে কত মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে সে বিষয়ে বাজেটে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
এ বাজেট প্রণয়নের আগে বিভিন্ন খাতের মানুষের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনা করেছিলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। সেসব আলোচনায় তিনি যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন তা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ।
তিনি উল্লেখ করেছিলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হবে আগামী অর্থবছরের বাজেটের মূল লক্ষ্য। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ০৫ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের মধ্যে এ মূল্যস্ফীতি কোন পর্যায়ে নেমে আসতে পারে সে বিষয়ে কোনো প্রক্ষেপণ নেই বাজেটে।
কর আদায়ে চাপ বাড়ানো হয়েছে বিভিন্ন খাতে। ‘এম এস প্রোডাক্ট’ উৎপাদনে সুনির্দিষ্ট কর প্রায় ২০% বাড়ানো হয়েছে। নির্মাণসেবায় ভ্যাট ৭.৫% থেকে বাড়িয়ে ১০%, অনলাইন পণ্য বিক্রয়ের কমিশনে ভ্যাট ৫% থেকে ১৫%, কটন সুতা ও কৃত্রিম আঁশের ইয়ার্ন উৎপাদনে সুনির্দিষ্ট কর ৩ টাকা থেকে ৫ টাকা, প্লাস্টিক টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, টয়লেট্রিজে ভ্যাট ৭.৫% থেকে ১৫%, ব্লেড উৎপাদনে ভ্যাট ৫% থেকে ৭.৫% সেলফ কপি ও ডুপ্লেক্স বোর্ডে ভ্যাট ৭.৫% থেকে ১৫% করা হয়েছে। এ ছাড়া ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ১০% সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
ভোক্তাদের স্বস্তির জন্য কিছু পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। যেমন ব্যাংকে ১ লাখ টাকার স্থলে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত স্থিতির ওপর আবগারি শুল্ক থাকবে না। এলএনজি আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি, স্যানিটারি ন্যাপকিন, তরল দুধ, বলপয়েন্ট, ২২ ইঞ্চির বদলে ৩০ ইঞ্চি পর্যন্ত কম্পিউটার মনিটরের উৎপাদন ও ব্যবসা, আইসক্রিমের সম্পূরক শুল্ক ১০% থেকে কমিয়ে ৫% করা হয়েছে।
একসময় বাজেটের সবচেয়ে বড় ব্যয়ের খাত ছিল শিক্ষা। কিন্তু ধীরে ধীরে সরকারের প্রাধিকার স্থানান্তরিত হতে থাকে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ধীরে ধীরে ভৌত অবকাঠামো খাতে বরাদ্দ বাড়তে থাকে। আর এসব অবকাঠামো বাস্তবায়নে দেশি-বিদেশি নানা উৎস থেকে অনেক বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়া হয়। এসব ঋণের মধ্যে অনেক অপ্রয়োজনীয় ঋণও ছিল। সময়ের পরিক্রমায় সেসব ঋণ পরিশোধের সময় হয়েছে। ফলে বর্তমানে বাজেটের খাতভিত্তিক ব্যয়ে সবচেয়ে বড় ব্যয়ের খাত হিসেবে স্থান দখল করে নিয়েছে ঋণের সুদ পরিশোধ। আগামী অর্থবছরের জন্য ঋণের সুদ পরিশোধে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ২২ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এসব ঋণের ঘানি আরও অনেক দিন টানতে হবে জাতিকে।
একদিকে ঋণের সুদ বৃদ্ধি অন্যদিকে সরকারের অন্যান্য পরিচালন ব্যয়ও বেড়ে চলেছে। ফলে বর্তমানে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে যে রাজস্ব আহরণ হয়, তার প্রায় পুরোটাই চলে যায় পরিচালন ব্যয় মেটাতে। ফলে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সরকারের হাতে উদ্বৃত্ত কোনো অর্থ থাকে না। ফলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রায় পুরোটাই হয়ে পড়ছে ঋণনির্ভর।
আগামী অর্থবছরের জন্য এডিপির আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর বাজেটের ঘাটতি ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে সরকার তার রাজস্ব আয় থেকে মাত্র ৪ হাজার কোটি টাকা দিতে পারবে উন্নয়ন খাতে। বাকি পুরোটা আসবে ঋণ থেকে।
আওয়ামী লীগ শাসনামলে সরকারি ব্যয়ের যেসব নতুন খাত সৃষ্টি হয়েছে এবং যেসব অযৌক্তিক ব্যয়ের খাত সৃষ্টি করা হয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করা এবং অপ্রয়োজনীয় পরিচালন ব্যয় সংকোচনের বিষয়ে কোনো ধরনের সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বাজেটে লক্ষ করা যায়নি। ফলে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের যে আকাঙ্খা নিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল তা অর্জিতই থেকে যেতে পারে।