০৪:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫
শেরপুরের বিপ্লবী রবি নিয়োগীঃ ৯২

বছরের ৪৫ বছর জেলে না হয় আত্মগোপনে স্বাধীনতা পুরস্কার কি তিনি পাবেন না?

রবীন্দ্র নাথ পাল, ময়মনসিংহ :
  • আপডেট: ১১:২২:১৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
  • / 31
অগ্নিযুগের অগ্নিপুরুষ ব্রিটিশ বিরোধী  আন্দোলন থেকে দেশের স্বাধীনতা ৷  আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের  সংগঠক বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের গর্বের ধন শেরপুরের বিপ্লবী রবি নিয়োগী। যাকে সবাই জানে,চিনে,এ রকম একজন ক্ষনজন্মা বীরকে আমরা আজ  ভুলে গেছি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যাকে চিনতেন- জানতেন,একসাথে জেল খেটেছেন,সেই বরেন্য বীরযোদ্ধাকে এ দেশ তার কর্মের কোন স্বীকৃতি দেয়নি। এ লজ্জা কি আমাদের সবার নয়। ভাবতে অবাক লাগে জাতি হিসেবে আমরা কতটা অকৃতজ্ঞ।
বলছিলাম বৃহত্তর ময়মনসিংহের সিংহ পুরুষ শেরপুরের জাতি ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে সবার নয়নের মনি প্রয়াত বিপ্লবী রবি নিয়োগীর কথা। এভাবে চলতে থাকলে আগামী প্রজন্ম রবি নিয়োগীর অবদান সম্পর্কে কিছুই জানতে পারবে না। আমরা যদি আমাদের উত্তরসূরীদের অবমুল্যায়ন করি, তবে বর্তমান প্রজন্মও একদিন আমাদের অবমুল্যায়ন করবে। যারা ইতিহাস মুছে ফেলতে চায়,তারা জানেননা ইতিহাসও তাদের মুছে ফেলে।এটাই বাস্তবতা।
ভাবতে অবাক লাগে ৯২ বছরের একটি জীবনে তিনি ৪৫ বছর হয় জেলে না আত্মগোপনে ছিলেন। আজো এই মহান বীর সেনানীকে স্বাধীনতা পুরস্কার আমরা দিতে পারিনি। এ দায় ও লজ্জা কি সবার নয়?
রবি নিয়োগী জন্মেছিলেন শেরপুর শহরের এক বর্ধিঞ্চু ভূস্বামী পরিবারে। পিতা রমেশ চন্দ্র নিয়োগী ও মাতা সুরবালা নিয়োগী ছিলেন দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ। তাই শিশুকাল থেকেই রবি দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠেন।
ব্রিটিশশাসিত স্বদেশকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি মাত্র ১১ বছর বয়সে, ১৯২১ সালে আলী ভ্রাতাদের নেতৃত্বে পরিচালিত খেলাফত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
শেরপুরের গণমিছিলে যোগদান করে বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তোলেন, ‘আলী ভাই জিন্দাবাদ, খেলাফত আন্দোলন জিন্দাবাদ’।
 ১৯২৬ সালে ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় তরুণ বয়সেই রবি নিয়োগী ভারত বর্ষের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়তে সশস্ত্র বৈপ্লবিক পন্থা বেছে নেন। ‘যুগান্তর’ পার্টির সদস্য হন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অপরাধে ১৯২৭ সালে আনন্দমোহন কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে। তখন তিনি কলকাতায় চলে গিয়ে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হন।
সেখানেই তিনি নিষিদ্ধঘোষিত যুগান্তর পার্টির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সক্রিয়ভাবে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন।
১৯২৯ সালে সারা ভারতবর্ষে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে আন্দোলনকে সংগঠিত করার জন্য রবি নিয়োগী পড়ালেখার পাট চুকিয়ে কলকাতা থেকে শেরপুরে চলে আসেন। জিতেন সেন, জলধর পাল, হেমন্ত ভট্টাচার্য, প্রমথ গুপ্ত প্রমুখ নেতাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি শেরপুরের আইন অমান্য আন্দোলন বেগবান করে তোলেন।
১৯৩০ সালে কংগ্রেসের আহ্বানে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হলে শেরপুর অঞ্চলের ১৭ জন সত্যাগ্রহীর সঙ্গে রবি নিয়োগী প্রথম কারাবরণ করেন।
৩০–এর দশকে ব্রিটিশ শাসন অবসানের জন্য মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটে। এই সংগ্রামের ধারায় রবি নিয়োগীসহ বেশ কয়েকজন বিপ্লবী শেরপুর-জামালপুর অঞ্চলে ব্রিটিশবিরোধী নানা সশস্ত্র তৎপরতায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
১৯৩১ সালে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের বিচারে রবি নিয়োগীকে সাত বছর কারাদণ্ড দিয়ে ময়মনসিংহের জেলে পাঠানো হয়। বন্দী থাকা অবস্থায় রাজবন্দীদের মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে তিনি আন্দোলন শুরু করলে ইংরেজ সরকার তাঁকে রাজশাহী জেলে নিয়ে ফাঁসির আসামিদের জন্য চিহ্নিত কনডেম সেলে রাখে। সে সময় রাজশাহী জেলে বন্দী বিপ্লবীরা ইংরেজ জেল সুপারকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেন। ফলে রবি নিয়োগীসহ বেশ কয়েকজন বিপ্লবীকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। ব্রিটিশ সরকার তাঁর নামের আগে যুক্ত করে ২টি তারকা চিহ্ন, যার অর্থ রবি নিয়োগী ব্রিটিশ সরকারের জন্য অতি বিপজ্জনক রাজবন্দী। দেশের কারাগারে তাঁকে বন্দী রাখা নিরাপদ নয় মনে করে ইংরেজ সরকার তাঁকে ‘কালাপানি’খ্যাত আন্দামান সেলুলার জেলে প্রেরণ করে ১৯৩১ সালে।
আন্দামান জেলে থাকাকালে ৩২ বিপ্লবীসহ রবি নিয়োগী অক্টোবর বিপ্লব ও মার্কসবাদকে মানবমুক্তির পথ হিসেবে বেছে নিয়ে পড়াশোনা করার মাধ্যমে মার্কসবাদ চর্চা শুরু করেন এবং কমিউনিস্ট কনসলিডেশন গড়ে তোলেন। তাঁদের জেলে অবস্থানকালেই প্রথম কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন গড়ে ওঠে ভারতে। পরবর্তীকালে আন্দামান জেল থেকে মুক্ত হয়ে বিপ্লবীরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে কমিউনিস্ট মতাদর্শ প্রচার ও কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন গড়ে তোলার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।রবি নিয়োগী নানকার, ভাওয়ালী, টঙ্ক, তেভাগা, কৃষক আন্দোলন, স্বাধিকার, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর নামের আগে ব্রিটিশ সরকার দুইটি তারকা চিহ্ন সেঁটে দেওয়ায় ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সরকারের শাসনামলে তাঁকে সব মিলিয়ে ৩৪ বছর জেলে এবং ১১ বছর গৃহ-অন্তরীণ ও আত্মগোপনে কাটাতে হয়েছে।
১৯৩৮ সালে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের অন্যতম ব্যক্তিত্ব নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু শেরপুরে এক জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন সদ্য আন্দামান১৯৪১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজাফ্‌ফর আহমদ, বিপ্লবী নেতা ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীসহ বহু বিশিষ্ট নেতার উপস্থিতিতে রবি নিয়োগী জ্যোৎস্না মজুমদারকে বিয়ে করেন।
বিয়ের এক বছরের মধ্যে জ্যোৎস্না নিয়োগী তাঁর বিচক্ষণতা ও কর্মদক্ষতার গুণে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করে স্বামীর জীবনাদর্শের একান্ত বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে ওঠেন। তিনিও পাকিস্তান আমলে ২ বারে ৯ বছর কারাভোগ করেছেন।
রবি নিয়োগী ও জ্যোৎস্না নিয়োগী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন সাংস্কৃতিক আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনের পাথেয় হিসেবে কাজ করে। তাই শেরপুরে সাংস্কৃতিক আন্দোলন বেগবান করার লক্ষ্যে তাঁরা পাতা বাহার খেলাঘর আসর ও উদীচীর শাখা গড়ে তোলার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
মানবকল্যাণমূলক কাজে নিয়োগী দম্পতি নিরলস কাজ করে গেছেন। ১৯৬৪-৬৫ সালে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দী ছিলেন রবি নিয়োগী। তাঁদের মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
শেরপুর জেলার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু সর্বদা নিয়োগী পরিবারের খোঁজখবর নিতেন। ঐতিহাসিক ৬ দফা প্রণয়নের পর বঙ্গবন্ধু সাংগঠনিক সফরে শেরপুরে আসেন। এ সময় তিনি ব্যস্ততার মধ্যেও নিয়োগী বাড়িতে উপস্থিত হয়ে জ্যোৎস্না নিয়োগীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
রবি নিয়োগী ৯২ বছর জীবিত ছিলেন। তার মধ্যে কারাগারে, গৃহ-অন্তরীণ ও আত্মগোপনে কাটিয়েছেন জীবনের মূল্যবান ৪৫ বছর। আমাদের দেশের মানুষ নেলসন ম্যান্ডেলার ৩৩ বছর কারাভোগের কাহিনি শুনে বিস্মিত হন, কিন্তু নিজ দেশের অগ্নিপুরুষ, বিপ্লবী রবি নিয়োগীর নাম তাঁদের জানা নেই।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে, এই বিপ্লবীর অসীম সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের বীরগাথা লোকচক্ষুর সম্মুখে আনার কোনো প্রয়াস আজ পর্যন্ত কেউ করেননি, তবুও রবি নিয়োগী তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে গণমানুষের মনে বেঁচে থাকবেন চিরকাল।
মহান এ বিপ্লবী মহানায়ক ২০০২ সালের ১০ মে ইহধাম ত্যাগ করে পরপারে চলে যান।
তথ্য সংগ্রহঃ রবি নিয়োগীর কন্যা :মঞ্জুশ্রী নিয়োগী দাশগুপ্তা,বীর মুক্তিযোদ্ধার লেখা থেকে।
শেয়ার করুন
ট্যাগ :

আপনার মন্তব্য লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন

শেরপুরের বিপ্লবী রবি নিয়োগীঃ ৯২

বছরের ৪৫ বছর জেলে না হয় আত্মগোপনে স্বাধীনতা পুরস্কার কি তিনি পাবেন না?

আপডেট: ১১:২২:১৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
অগ্নিযুগের অগ্নিপুরুষ ব্রিটিশ বিরোধী  আন্দোলন থেকে দেশের স্বাধীনতা ৷  আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের  সংগঠক বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের গর্বের ধন শেরপুরের বিপ্লবী রবি নিয়োগী। যাকে সবাই জানে,চিনে,এ রকম একজন ক্ষনজন্মা বীরকে আমরা আজ  ভুলে গেছি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যাকে চিনতেন- জানতেন,একসাথে জেল খেটেছেন,সেই বরেন্য বীরযোদ্ধাকে এ দেশ তার কর্মের কোন স্বীকৃতি দেয়নি। এ লজ্জা কি আমাদের সবার নয়। ভাবতে অবাক লাগে জাতি হিসেবে আমরা কতটা অকৃতজ্ঞ।
বলছিলাম বৃহত্তর ময়মনসিংহের সিংহ পুরুষ শেরপুরের জাতি ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে সবার নয়নের মনি প্রয়াত বিপ্লবী রবি নিয়োগীর কথা। এভাবে চলতে থাকলে আগামী প্রজন্ম রবি নিয়োগীর অবদান সম্পর্কে কিছুই জানতে পারবে না। আমরা যদি আমাদের উত্তরসূরীদের অবমুল্যায়ন করি, তবে বর্তমান প্রজন্মও একদিন আমাদের অবমুল্যায়ন করবে। যারা ইতিহাস মুছে ফেলতে চায়,তারা জানেননা ইতিহাসও তাদের মুছে ফেলে।এটাই বাস্তবতা।
ভাবতে অবাক লাগে ৯২ বছরের একটি জীবনে তিনি ৪৫ বছর হয় জেলে না আত্মগোপনে ছিলেন। আজো এই মহান বীর সেনানীকে স্বাধীনতা পুরস্কার আমরা দিতে পারিনি। এ দায় ও লজ্জা কি সবার নয়?
রবি নিয়োগী জন্মেছিলেন শেরপুর শহরের এক বর্ধিঞ্চু ভূস্বামী পরিবারে। পিতা রমেশ চন্দ্র নিয়োগী ও মাতা সুরবালা নিয়োগী ছিলেন দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ। তাই শিশুকাল থেকেই রবি দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠেন।
ব্রিটিশশাসিত স্বদেশকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি মাত্র ১১ বছর বয়সে, ১৯২১ সালে আলী ভ্রাতাদের নেতৃত্বে পরিচালিত খেলাফত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
শেরপুরের গণমিছিলে যোগদান করে বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তোলেন, ‘আলী ভাই জিন্দাবাদ, খেলাফত আন্দোলন জিন্দাবাদ’।
 ১৯২৬ সালে ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় তরুণ বয়সেই রবি নিয়োগী ভারত বর্ষের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়তে সশস্ত্র বৈপ্লবিক পন্থা বেছে নেন। ‘যুগান্তর’ পার্টির সদস্য হন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অপরাধে ১৯২৭ সালে আনন্দমোহন কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে। তখন তিনি কলকাতায় চলে গিয়ে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হন।
সেখানেই তিনি নিষিদ্ধঘোষিত যুগান্তর পার্টির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সক্রিয়ভাবে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন।
১৯২৯ সালে সারা ভারতবর্ষে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে আন্দোলনকে সংগঠিত করার জন্য রবি নিয়োগী পড়ালেখার পাট চুকিয়ে কলকাতা থেকে শেরপুরে চলে আসেন। জিতেন সেন, জলধর পাল, হেমন্ত ভট্টাচার্য, প্রমথ গুপ্ত প্রমুখ নেতাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি শেরপুরের আইন অমান্য আন্দোলন বেগবান করে তোলেন।
১৯৩০ সালে কংগ্রেসের আহ্বানে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হলে শেরপুর অঞ্চলের ১৭ জন সত্যাগ্রহীর সঙ্গে রবি নিয়োগী প্রথম কারাবরণ করেন।
৩০–এর দশকে ব্রিটিশ শাসন অবসানের জন্য মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটে। এই সংগ্রামের ধারায় রবি নিয়োগীসহ বেশ কয়েকজন বিপ্লবী শেরপুর-জামালপুর অঞ্চলে ব্রিটিশবিরোধী নানা সশস্ত্র তৎপরতায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
১৯৩১ সালে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের বিচারে রবি নিয়োগীকে সাত বছর কারাদণ্ড দিয়ে ময়মনসিংহের জেলে পাঠানো হয়। বন্দী থাকা অবস্থায় রাজবন্দীদের মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে তিনি আন্দোলন শুরু করলে ইংরেজ সরকার তাঁকে রাজশাহী জেলে নিয়ে ফাঁসির আসামিদের জন্য চিহ্নিত কনডেম সেলে রাখে। সে সময় রাজশাহী জেলে বন্দী বিপ্লবীরা ইংরেজ জেল সুপারকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেন। ফলে রবি নিয়োগীসহ বেশ কয়েকজন বিপ্লবীকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। ব্রিটিশ সরকার তাঁর নামের আগে যুক্ত করে ২টি তারকা চিহ্ন, যার অর্থ রবি নিয়োগী ব্রিটিশ সরকারের জন্য অতি বিপজ্জনক রাজবন্দী। দেশের কারাগারে তাঁকে বন্দী রাখা নিরাপদ নয় মনে করে ইংরেজ সরকার তাঁকে ‘কালাপানি’খ্যাত আন্দামান সেলুলার জেলে প্রেরণ করে ১৯৩১ সালে।
আন্দামান জেলে থাকাকালে ৩২ বিপ্লবীসহ রবি নিয়োগী অক্টোবর বিপ্লব ও মার্কসবাদকে মানবমুক্তির পথ হিসেবে বেছে নিয়ে পড়াশোনা করার মাধ্যমে মার্কসবাদ চর্চা শুরু করেন এবং কমিউনিস্ট কনসলিডেশন গড়ে তোলেন। তাঁদের জেলে অবস্থানকালেই প্রথম কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন গড়ে ওঠে ভারতে। পরবর্তীকালে আন্দামান জেল থেকে মুক্ত হয়ে বিপ্লবীরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে কমিউনিস্ট মতাদর্শ প্রচার ও কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন গড়ে তোলার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।রবি নিয়োগী নানকার, ভাওয়ালী, টঙ্ক, তেভাগা, কৃষক আন্দোলন, স্বাধিকার, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর নামের আগে ব্রিটিশ সরকার দুইটি তারকা চিহ্ন সেঁটে দেওয়ায় ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সরকারের শাসনামলে তাঁকে সব মিলিয়ে ৩৪ বছর জেলে এবং ১১ বছর গৃহ-অন্তরীণ ও আত্মগোপনে কাটাতে হয়েছে।
১৯৩৮ সালে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের অন্যতম ব্যক্তিত্ব নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু শেরপুরে এক জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন সদ্য আন্দামান১৯৪১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজাফ্‌ফর আহমদ, বিপ্লবী নেতা ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীসহ বহু বিশিষ্ট নেতার উপস্থিতিতে রবি নিয়োগী জ্যোৎস্না মজুমদারকে বিয়ে করেন।
বিয়ের এক বছরের মধ্যে জ্যোৎস্না নিয়োগী তাঁর বিচক্ষণতা ও কর্মদক্ষতার গুণে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করে স্বামীর জীবনাদর্শের একান্ত বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে ওঠেন। তিনিও পাকিস্তান আমলে ২ বারে ৯ বছর কারাভোগ করেছেন।
রবি নিয়োগী ও জ্যোৎস্না নিয়োগী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন সাংস্কৃতিক আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনের পাথেয় হিসেবে কাজ করে। তাই শেরপুরে সাংস্কৃতিক আন্দোলন বেগবান করার লক্ষ্যে তাঁরা পাতা বাহার খেলাঘর আসর ও উদীচীর শাখা গড়ে তোলার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
মানবকল্যাণমূলক কাজে নিয়োগী দম্পতি নিরলস কাজ করে গেছেন। ১৯৬৪-৬৫ সালে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দী ছিলেন রবি নিয়োগী। তাঁদের মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
শেরপুর জেলার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু সর্বদা নিয়োগী পরিবারের খোঁজখবর নিতেন। ঐতিহাসিক ৬ দফা প্রণয়নের পর বঙ্গবন্ধু সাংগঠনিক সফরে শেরপুরে আসেন। এ সময় তিনি ব্যস্ততার মধ্যেও নিয়োগী বাড়িতে উপস্থিত হয়ে জ্যোৎস্না নিয়োগীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
রবি নিয়োগী ৯২ বছর জীবিত ছিলেন। তার মধ্যে কারাগারে, গৃহ-অন্তরীণ ও আত্মগোপনে কাটিয়েছেন জীবনের মূল্যবান ৪৫ বছর। আমাদের দেশের মানুষ নেলসন ম্যান্ডেলার ৩৩ বছর কারাভোগের কাহিনি শুনে বিস্মিত হন, কিন্তু নিজ দেশের অগ্নিপুরুষ, বিপ্লবী রবি নিয়োগীর নাম তাঁদের জানা নেই।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে, এই বিপ্লবীর অসীম সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের বীরগাথা লোকচক্ষুর সম্মুখে আনার কোনো প্রয়াস আজ পর্যন্ত কেউ করেননি, তবুও রবি নিয়োগী তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে গণমানুষের মনে বেঁচে থাকবেন চিরকাল।
মহান এ বিপ্লবী মহানায়ক ২০০২ সালের ১০ মে ইহধাম ত্যাগ করে পরপারে চলে যান।
তথ্য সংগ্রহঃ রবি নিয়োগীর কন্যা :মঞ্জুশ্রী নিয়োগী দাশগুপ্তা,বীর মুক্তিযোদ্ধার লেখা থেকে।
শেয়ার করুন